এটম বোমা আবিস্কারের ইতিহাস


বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে। ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে তিনি মানুষের চিন্তার জগতে কয়েকটি বৈপ্লবিক ধারনার সৃষ্টি করেছিলেন। এই ধারণাগুলির মধ্যে ভর ও শক্তির বিনিময়তা ছিল অন্যতম। তার সেই বিখ্যাত সমীকরণটি হল, E=mc2। এখানে E দ্বারা শক্তি m দ্বারা ভর এবং c দ্বারা প্রতি সেকেন্ডে আলোর বেগকে বোঝান হয়েছে। অর্থাৎ পদার্থের ভরকে আলোর বেগের বর্গ দ্বারা গুণ করলে যে শক্তি পাওয়া যায় সেটাই হল ঐ পরিমাণ পদার্থের আবদ্ধ শক্তি।

আমরা জানি যে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩০ কোটি মিটার অর্থাৎ ১৮৬০০০ মাইল । সুতরাং খুব অল্প পরিমাণ পদার্থকেও যদি ৩০ কোটির বর্গ দিয়ে গুণ করা হয় তাহলে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে সেটার হিসাব বের করা খুব কঠিন নয়। তখন তার মর্ম না বুঝলে ও পরবর্তিতে তার মর্ম যথাযথ ভাবে বুঝেছে মানুষ।

দুই হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস পরমাণুর ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন। atom ইংরেজি শব্দ যার প্রতি শব্দ পরমাণু। যাকে আর ভাগ করা যায় না। ডেমোক্রিটাসের মতে, ‘পৃথিবীতে একমাত্র বিদ্যমান পদার্থ হল পরমাণু ও শুণ্যস্থান, আর বাকি সব কিছু অভিমত মাত্র।

উনবিংশ শতাব্দীতে জন ডালটন পদার্থের পারমাণবিক গঠনের ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ডালটনের মতবাদের অনেক সমালোচনা হওয়ার পর বেকারেল, পিয়ারে কুরি ও মেরি কুরি বিজ্ঞানী কতৃক তেজষ্ক্রিয় মৌলের আবিষ্কার, থমসন কতৃক ইলেকট্রনের আবিষ্কার এবং ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম ও থোরিয়াম থেকে নির্গত তেজষ্ক্রিয় রশ্নির অনুশীলন করার পর সন্দেহের কোন অবকাশ রইল না যে পদার্থের গঠন সত্যিই পারমানবিক। পরবর্তিতে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড পরমাণুর একটি মডেল আবিষ্কার করেন। যেখানে তিনি বলেছেন পরমাণুর একটি কেন্দ্র আছে যার নাম নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে থাকে ধনাত্নক আধান বিশিষ্ট প্রোটন এবং চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রন। আর নিউক্লিয়াসের বাইরে বৃত্তাকার কক্ষ পথে থাকে ঋণাত্নক আহিত ইলেকট্রন। ইলেকট্রন গুলো সর্বদা ঘূর্ণায়মান। পরমাণুর মোট ভরের শতকরা ৯৯.৯৭৫ অংশ অবস্থিত এই নিউক্লিয়াসে। এর গড় ঘনত্ব প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে প্রায় ৩x১০০০০০০০০০০০০ কিলোগ্রাম। পরমাণুর উপাদান প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রনের মোট ভরের তুলনায় পরমানুটির ভর যতটা কম তাকেই শক্তির একক কে E=mc2 প্রকাশ করলে আমরা পরমাণুর সংযোগী শক্তির সন্ধান পাই।

১৯৩৮ সালে জার্মানীর অটোহান এবং স্ট্র্যাসম্যান নামে দুইজন রসায়মবিদ ইউরিনিয়াম ২৩৫ মৌলের পরমাণু ভাঙ্গতে সফল হন। ফলে সারা বিশ্বে হৈচৈ পড়ে যায়। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৮ সালের এক অধিবেশনে বোর পরমাণুর ভাঙ্গন ও তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীদের কাছে ঘোষণা করলেন। বোরের ভাষণ শেষ হওয়ার আগেই শ্রোতাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন দ্রুত সভাকক্ষ ত্যাগ করে টেলিফোনে ব্যাপারটা স্ব স্ব গবেষণাগারে জানিয়ে দিলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই ওয়াশিঙটনের কারনেজ ইনস্টিটউশন এবং কলম্বিয়া বিম্ববিদ্যায়ের বিজ্ঞানীরা হানস্ট্র্যাসমেন আবিষ্কারকে স্বীকৃতি জানালেন। কারণ পারমাণবিক বোমা নির্মাণের চাবিকাঠি নিহিত ছিল এই আবিষ্কারটিতে। নির্ধারিত কোন কোন ভারী পরমাণুর একের পর এক পর্যায়ক্রমিক বিভাজন প্রক্রিয়াকে সমপ্রতিক্রিয়াধারা বলা হয়। সহজে বিদারণীয় মৌল দ্বারা বন্দীকৃত এই নিউট্রিন পরবর্তী পর্যায়ের বিভাজন ঘটায় এবং এ ভাবেই ধারাটা চলতে থাকে। পারমাণবিক বোমায় এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। পারমাণবিক শক্তি বা অস্ত্র উৎপাদনের জন্য দরকার এমন একটি প্রক্রিয়ার সূচনা করা যাকে বলা হয় সমপ্রতিক্রিয়াধারা। ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়াস মোটামুটি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হলে যদি সেই সাথে এক বা একাধিক নিউট্রন নির্গত হয় তাহলেই শুধু সমপ্রতিক্রিয়াধারা ঘটানো সম্ভব। ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে জোলিয়ো কুরি ও তার সহযোগিরা দেখালেন যে ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়াস ভাঙ্গলে নিউট্রন বের হয়ে আসে। এ আবিষ্কারের মারাত্নক সম্ভাবনা ও পরিণতি সম্বন্ধে ঝিলার্ড ও ফার্মী সচেতন ছিলেন। যার ফলে ঝিলার্ড ও ফার্মী আগে থেকে ইউরিনিয়াম ভাঙ্গার রহস্য প্রকাশ করেন নি এবং জোলিয়ো ও কুরিকে তা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু জোলিয়ো ও কুরি বুঝলেন উল্টো। তারা মনে করলেন ঝিলার্ড ও ফার্মী তাদের আগে তা প্রকাশ করে করবেন। সমসাময়িক সময়ে সমপ্রতিক্রিয়াধারা অন্বেষনে ফরাসীরা অন্যদের তুলনায় বেশ অনেকখানি এগিয়ে ছিল। তাই জোলিয়ো ও কুরি গোপনীয়তার কথা প্রত্যাখান করলেন। ১৯৩৯ সালের ১৫ এপ্রিল ফিজিক্যাল রিভউ পত্রিকায় প্রকাশিত হল ঝিলার্ড ও তার সহকর্মীদের প্রবন্ধ। এক সপ্তাহ পরে ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়াস বিভাজনে নির্গত নিট্রনের সংখ্যা। শিরোনামে ফরাসী বিজ্ঞানীদের একটি নতুন প্রবন্ধ 'দি নেচার' প্রত্রিকায় প্রকাশিত হল। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল নিউট্রনের গড় সংখ্যা ৩ থেকে ৪ এর মধ্যে। ফরাসী বিজ্ঞানীরা দ্রুত ৫টি পেটেন্ট গ্রহণ করে তাদের অগ্রগামী অবস্থার পরিচয় দিলেন। ইউরিনিয়াম ও মডারেটর কি অনুপাতে সন্নিবিষ্ট করতে হবে এবং সন্নিবেশে তাদের সমসত্ব ও অসমসত্ব বিন্যাস এ পেনেন্টে উল্লেখ ছিল। বিভাজনে নির্গত নিউট্রন মন্দনের জন্য মডেরেটর হিসাবে বেরিলিয়াম, গ্রাফাইট, পানি এবং ভারী পানি ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সমপ্রতিক্রিয়াধারাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বেশ কয়েকটি উপায় আলোচিত হয়েছিল এবং উৎপন্ন তাপকে কিভাবে সংগ্রহ করা যায় সে সম্বন্ধে কয়েকটি পদ্ধতিও এ পেটেন্টে বর্নিত হয়েছিল। ইউরিনিয়াম ২৩৫ এর মত সহজে বিদারণীয় পদার্থ যা বিস্ফোরণমূখী হয়ে দ্রূত নিউট্রন সমপ্রতিক্রিয়াধারার সৃষ্টি করে সে কৌশলকে পারমাণবিক বোমা বলে।


১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগেই ফরাসী বিজ্ঞানীরা পারমানবিক বোমা ও শক্তি উৎপাদনের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে হিটলার ঘোষনা করেছিলেন যে জার্মানীর হাতে এমন এক ভয়ংকর গোপন অস্ত্র আছে যার গতি রোধ বা ধ্বংশ করার কৌশল কারোর জানা নেই। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বিজ্ঞানী ছাদউইককে হিটলারের গোপন অস্ত্রের শক্তির উৎস অনুসন্ধান করার অনুরোধ করেন। ছাদউইক তার প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছিলেন যে ১ থেকে ৩০ টন ইউরিনিয়াম যোগার করতে পারলে এই ধরনের বোমা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু অটো ফ্রিস ও রুডলফ পিয়ারলস বিজ্ঞানীদ্বয় হিসাব করে দেখালেন যে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের পরিবর্তে যদি খাঁটি ইউরেনিয়াম ২৩৫ মৌল ব্যবহার করা হয় তাহলে ১ থেকে ৩০ টন ইউরেনিয়ামের দরকার নেই বরং কয়েক পাউন্ড ইউরেনিয়াম হলেই বিষ্ফোরণ ঘটানো সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটোপ পৃথক করার কৌশক তখনো বিজ্ঞানীদের জানাছিল না। তবুও ব্রিটিশ সরকার ছাদউইককে বোমা তৈরীর দায়িত্ব দেন। তাঁর সাথে আছেন অটো ফ্রিস ও রুডলফ পিয়ারলস। যে সকল ইহুদি বিজ্ঞানীরা হিটলারের ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে জার্মান ত্যাগ করেছিলেন তাদের মধ্যে পিয়ারলস, আইনস্টাইন, ঝিলার্ড, বিগনার, টেলরের নাম উল্লেখযোগ্য। মজার ব্যপার হল দেশত্যাগী বিজ্ঞানীরাই ব্রিটিশ ও যুক্তরাষ্ট্রকে পারমানবিক বোমা তৈরির সম্ভাব্যতার কথা বুঝিয়েছিলেন। পরে ব্রিটিশ সরকার অলিফেন্ট, থমসন ও ব্লাকেট বিজ্ঞানীদেরকে নিয়ে গঠন করেন থমসন কমিটি। এই থমসন কমিটিই পরে মড কমিটিতে রূপ নেয়। এই কমিটি দ্ব্যার্থহীন ভাবে সুপারিশ করেছিল “এই কমিটির বিবেচনায় পারমানবিক বোমা তৈরীর পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত এবং যুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল অর্জনে এই বোমার উপযোগীতা অনস্বীকার্য। অপর দুই বাস্তুহারা হাঙ্গেরীয় বিজ্ঞানী ঝিলার্ড ও এডওয়ার্ড টেলর যুক্তরাষ্টকে পারমানবিক বোমা তৈরীর ব্যপারে উৎসাহিত করেন। তাদের কথায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার কান না দেওয়ায় তারা দুই জন আইনস্টাইনের কাছে যান এবং তাকে অনুরোধ করেন তিনি যেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লিখে এ ব্যপারটি বুঝিয়ে বলেন। পরবর্তীতে আইনস্টাইন রুজভেল্টকে কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন। রুজভেল্ট ও বুজতে পারলেন হিটলার যদি এই বোমা তৈরী করতে পারেন তাহলে সব সর্বনাস হয়ে যাবে। তাই রুজভেল্ট এই ব্যপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তার সচিবকে নির্দেশ দেন।

সচিব ওয়াটসন তিন সদস্য বিশিষ্ট ব্রিগস কমিটি গঠন করেন। এ দিকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ জোরে সোরে শুরু হয়েছে। তখনও আমেরিকা যুদ্ধে জড়ায়নি। এ সময়ের মধ্যে ব্রিটেন পারমানবিক বোমা তৈরী কর্মসূচীর একটা খসড়া সম্পুর্ণ করেছিল। এই খসড়া থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের মধ্যে সামরিক দিক থেকে উপযোগী অস্ত্র তৈরীর সম্ভাবনা উজ্জল। যুক্তরাষ্টের ব্রিগস কমিটি ও জাতীয় একাডেমির সুপারিশগুলি তখনও পর্যম্ত এতটা অগ্রসর হতে পারেনি। ব্রিটেনের মড কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই রুজভেল্টকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে বায়বীয় ব্যাপনের সাহায্যে পৃথকীকৃত ইউরেনিয়াম ২৩৫ মৌলের সাহায়্যে পারমানবিক অস্ত্র তৈরী সম্ভব। পারমানবিক বোমা তৈরীর কলাকৌশল ব্রিটেন ও আমেরিকার মধ্যে আদান প্রদান শুরু হয়। সাথে সাথে আমেরিকা ও ব্রিটেনের মিত্র দেশ গুলোর সাথেও পারমানবিক বোমা তৈরির কলাকৌশল সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। ব্রিটেনের প্রযুক্তির জ্ঞান সরবরাহের জন্য রুজভেল্ট চার্চিলকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মধ্যে পারমানবিক বোমা তৈরীর কাজে ব্রিটেনই সব চেয়ে বেশী অগ্রগামী ছিল। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র পারমানবিক বোমা তৈরীর ক্ষেত্রে ব্রিটেনকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছিল। কতটা পেছনে পরেছিল ব্রিটেন তা আমেরিকার বোমা তৈরির একটি বাজেট দেখলেই বুঝা যাবে।

ইউরিনিয়াম ২৩৫ মৌল পৃথকীকরণ করার জন্য সেন্ট্রিফউজ প্লান্টের জন্য ৩৮ মিলিয়ন ডলার, বায়বীয় ব্যাপন প্লান্টের জন্য সীমাহীন ডলার, তড়িৎ চুম্বকীয় পৃথকীকরণের জন্য ১২ মিলিয়ন ডলার, প্লুটোনিয়াম গাদা তৈরির জন্য ২৫ মিলিয়ন ডলার এবং ভারী পানি উৎপাদনের জন্য ৩ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুই মিত্র ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় মিত্র রাশিয়াকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে পারমাণবিক বোমা তেরির উদ্যোগ গ্রহন করল। অবশ্য এটা জানা কথা যে ব্রিটেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কউই বলশেভিক রাশিয়াকে খুব একটা সুনজরে দেখে না। অতএব তাদের এই আচরণ অবাঞ্ছনীয় হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না।

কান টানলে যেমন মাথা এসে পড়ে, পারমানবিক বোমা সংক্রান্ত কোন আলোচনায় তেমনি, ‘ভারী পানির’ প্রসঙ্গ এসে পড়বেই। কিন্তু এই ভারী পানি বস্তুটি যেমন আমাদের অপরিচিত ঠিক তেমনি অতি দূর্লভ । আমরা জানি যে পানি একটি যৌগিক পদার্থ যার একটি অণুতে আছে দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু আর একটি অক্সিজেন পরমাণু । এর আগে ইউরিয়াম মৌলের আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলাম যে ইউরিয়াম তিনটি আইসোটোপয় অবস্থায় বিদ্যমান ইউরিনিয়াম ২৩৪, ইউরিনিয়াম ২৩৫ ও ইউরিনিয়াম ২৩৮। হাইড্রোজেন মৌল দুইটি আইসোটোপিয় অবস্থায় প্রকৃতিতে বিরাজ করে প্রোটিয়াম, ডয়টেরিয়াম। প্রোটিয়ামের ভর সংখ্যা ১.০০৭৮২u। প্রকৃতিতে বিদ্যমান হাইড্রোজেনের শতকরা ৯৯.৯৮৫ ভাগ এই প্রোটিয়াম। কিন্তু শতকরা মাত্র ০.০১৫ ভাগ হাইড্রোজেন বিরাজ করে যে আইসোটোপীয় অবস্থায় তার নাম ডয়টরিয়াম এবং তার ভর সংখ্যা ২.০১৪০u। সুতরাং প্রোটিয়ামকে আমরা হাল্কা হাইড্রোজেন এবং ডয়টরিয়ামকে ভারী হাইড্রোজেন বলতে পারি। আমাদের অতি পরিচিত পানির অণুতে আছে প্রোটিয়াম আর অক্সিজেন। কিন্তু আমরা যে ভারী পানির উল্লেখ করেছি সেই পদার্থটির অণুতে আছে ডয়টরিয়াম ও অক্সিজেন। এ জন্যই তাকে বলা হয় ভারী পানি। পারমাণবিক শক্তি বা অস্ত্র তৈরিতে একটি মহার্ঘ উপাদান এই ভারী পানি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় কয়েক বছর আগে থেকে পারমাণবিক শক্তি বা অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে চারটি সংস্থা গবেষণা চালাচ্ছিল। ব্রিটেনের থমসন কমিটি, ফ্রান্সের ফ্রেডারিক জোয়ালিয়োর নেতৃত্বে কলেজ ডি ফ্রান্স দল, জার্মান দল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিগস কমিটি। পারমাণবিক শক্তি ও বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে পরিচালিত গবেষণায় এই চারটি দলের মধ্যে ফরাসীরাই ছিল অগ্রগামী। ফরাসী দল ইতিমধ্যেই গ্রাফাইটকে মডারেটর হিসাবে ব্যবহার করে যে পরীক্ষা চালিয়েছিল তা থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব হয় নি। সুতরাং তারা ভারী পানিকে নিয়ন্ত্রক বা মডারেটর হিসাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। ১৯৪০ সালের প্রথম দিকে একমাত্র নরওয়ের রুকানে শিল্প মাত্রায় ভারী পানি তৈরী হচ্ছিল। ফরাসী বিজ্ঞানীরা ফরাসী সমরাস্ত্র মন্ত্রী দুত্রীকে এটা বোঝাতে সমর্থ হলেন যে নরওয়ের ভারী পানির ভান্ডার তাদের হস্তগত করা খুবই জরুরী। এ ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণের পুর্বেই ফরাসীরা যে সংবাদ পেল তা রীতিমত ভীতিকর। গোয়েন্দা সুত্রে তারা জানতে পারল জার্মানরা যে শুধু নরওয়ে কারখানার গোটা মজুদ ভান্ডার কেনার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে তাই নয় তারা আরও বেশি পরিমাণে এবং নিয়মীত ভারী পানি সরবরাহের জন্য তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ রকম জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় এগিয়ে এলেন লেফটেনান্ট জ্যাকুস আলিয়ার নামে একজন তরুন ফরাসী। আলিয়ার ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তাকে ফরাসী গোয়েন্দা সংস্থার একটি বিশেষ শাখায় একজন অফিসার হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। জার্মানদের পারমাণবিক গবেষণা সম্বন্ধে ফরাসীদের জ্ঞাত সব কিছুই আলিয়ার সমরাস্ত্র মন্ত্রীকে ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু এই জ্ঞান ছাড়াও তার যে গুণটি ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ তা হল তিনি যে ব্যাঙ্কের সদস্য ছিলেন সেই ব্যাঙ্কের বিরাট আর্থিক লগ্নি ছিল নোর্স্ক হাইড্রো কোম্পানীতে। আর এই হাইড্রো কোম্পানীই ছিল রুকান ভারী পানি কারখানার মালিক। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে আলিয়ার অসলোর উদ্দেশ্যে প্যারিস ত্যাগ করেন। পথে স্টকহল্ম থেকে তিনি তাদের গোয়েন্দা সংস্থার তিনজন সদস্যকে সাথে নিলেন। নোর্স্ক হাইড্রো কারখানাটির মহাপরিচালক ছিলেন ডক্টর এক্সেল উবার্ট। অসলোতে পৌছেই তিনি সত্বর উবার্টের সাথে সাক্ষাত করলেন। আলিয়ারের আগেই জার্মানরা উবার্টের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু উবার্ট যখন জার্মানীদের কাছ থেকে জানতে চান যে কি উদ্দেশ্যে তাদের ভারী পানির প্রয়োজন তখন তাদের জবাব গুলি শুনে তার মন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল। জার্মানরা আগে থেকে চেষ্টা করেও যা করায়ত্ত করতে পারে নি আলিয়ার তার বুদ্ধি ও কুশলতায় তা করায়ত্ত করতে সমর্থ হলেন। অর্থাৎ অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

চুক্তি অনুযায়ী নরওয়ের কাছে মজুদ ১৮৫ কিলোগ্রাম ভারী পানি ফরাসীদের হস্তগত হল। সে সময় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ তুমুল ভাবে চলছিল। ফরাসীরা নরওয়ে থেকে কিভাবে ভারী পানির পাত্র গুলো আনবেন সে চিন্তায় অস্থির কারণ জার্মান সৈন্যরা এই ভারী পানির পাত্র গুলোর দিকে কড়া দৃষ্টি রাখতেন। প্রথমে পরিকল্পনা করা হয় ভারী পানির ছাব্বিশটি পাত্র সাবমেরিন যোগে ফ্রান্সে আনা হবে। কিন্তু পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে আবার সরে আসলেন। অনেক কৌশলে জার্মানদের চোখে ধূলো দিয়ে আলিয়ার ও তার সহকর্মীরা ভারী পানি ভর্তি ছাব্বিশটি পাত্র বিমানে করে স্কটল্যান্ডের এডিনবারায় নিয়ে আসেন। সেখান থেকে এ পাত্রগুলোকে আবার লন্ডনে চালান করা হয়।

১৬ মার্চে আলিয়ার ও তার সহকর্মীরা প্যারিসে ফিরে এলেন। সংগে নিয়ে এলেন সে সময়কার পৃথিবীতে মজুদকৃত সমুদয় ভারী পানি। এই ভারী পানির পাত্র গুলোকে রাখা হল একটি কলেজের গুদামের মাটির নিচে। পাশাপাশি সেই গুদামের উপরে এমন একটি ছাদ নির্মান করা হল যা এক হাজার পাউন্ড বোমায়ও ক্ষতি করতে না পারে।

১৯৪০ সালের ১০ মে জার্মানী ফ্রান্স আক্রমন করে। জার্মানরা ফ্রান্সের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ক্ষিপ্রতার সাথে অগ্রসর হতে থাকে। ফরাসী সরকারের পতন আসন্ন। পরাজয় যখন খুবই সন্নিকটে সেই পরিস্থিতিতে ফরাসী সমরাস্ত্র মন্ত্রী দুত্রি নানা জামেলার মধ্যেও এই মহার্ঘ ভারী পানির কথা ভুলে যাননি। পরাজয়ের মুখোমুখি দাড়িয়েও তার মনে হল এ সেই পদার্থ যা একদিন অবস্থান্তরে ফরাসীদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তিনি জুলিয়ো কুরিকে নির্দেশ দিলেন যে এগুলি যেন শত্রুর করায়ত্ব না হয় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। জোলিয় কুরি হলবানকে নির্দেশ দিলেন সেগুলি প্রথমে মধ্য ফান্সের মন্ট দোরে নিয়ে যেতে এবং সেখান থেকে পরে ক্লেয়ারমন্ট ফেরান্ডে নিয়ে ব্যাংক ডি ফ্রান্সের সিন্দুকে সুরক্ষিত রাখতে। ভারী পানির পাত্র, কিছু রেডিয়াম এবং মুল্যবান দলিলপত্র মোটর গাড়িতে তুলে হলবান সপরিবারে যাত্রা শুরু করলেন। পরের দিন তিনি রিয়ম শহরে গিয়ে পৌছলেন। সেখানে একটি ছোট্র বাসায় হলবান তার যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করে নিলেন। তার আসল দরকার ছিল প্রবাহমান জলধারার। সেখানে জোলিয় কুরিসহ তার দলের অনেক বিজ্ঞানী উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই তারা পারমানবিক বোমা তৈরির ছোটখাট গবেষনার কাজ চালাতে থাকেন। হঠাৎ একদিন আলিয়ার এসে জানালেন শত্রু খুব দ্রুতবেগে অগ্রসর হচ্ছে তাই ফরাসী সরকার নির্দেশ দিয়েছেন যে ভারী পানির পাত্র গুলোকে অন্য কোন দেশে সরিয়ে নিতে। একটি গাড়িতে করে ভারী পানির পাত্রগুলোকে বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্দরে পৌচ্ছে হলবান ও কাউরস্কি একটি সাদাসিধে ব্রিটিশ জাহাজ দেখতে পেলেন যার নাম ব্রুমপার্ক। এই জাহাজে চাকুরি করতেন সাফোকের বিশতম আর্লের সাথে। সাফোক জাহাজের সকল নাবিককে মদ্য পান করিয়ে মাতাল করে রেখেছিলেন। সেই সুযোগে ভারী পানির পাত্র গুলোকে জাহাজে ভর্তি করা হয়। তাদের মনে সন্দেহ হল যদি জাহাজটি বোমার আঘাতে ডুবে যায় তাহলে তাদের পরিকল্পনা সব ব্যস্তে যাবে। তাই তারা একটি কাঠের ভেলার সাথে পাত্রগুলোকে শক্ত করে বেধে জাহাজে উঠালেন। অবশেষে অনেক বোমার আসন্ন আঘাত এগিয়ে ব্রুমপার্ক কর্ণওয়ালের দক্ষিণ কিনারায় এসে নিরাপদে অবস্থান করল। সেখান থেকে তারা লন্ডনে পৌছলেন।

নীলস বোর আইনস্টাইনের মত জগত জোড়া খ্যাতি লাভ করতে পারেন নি। তার খ্যাতি সীমাবদ্ধ ছিল ইউরোপ এবং তৎকালীন বিজ্ঞানী মহলে। কিন্তু তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানে তিনি যে একজন উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক সেটা প্রায় তর্কাতীত। হান ও স্ট্রসম্যান কর্তৃক ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়াস বিভাজনের পর বোর এই বিভাজনের যে তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন প্রধানত তারই ভিত্তিতে পারমানবিক বোমা তৈরি সম্ভব হয়েছিল। এটা জানা ছিল যে ইউরিনিয়ামের তিনটি বিভিন্ন আইসোটোপ এমন মিশ্রিত অবস্থায় বিদ্যমান যে তাদেরকে আলাদা করা প্রায় দুঃসাধ্য। এই মিশ্রণে শতকরা ৯৯ ভাগ হল ইউরিনিয়াম ২৩৮। এক হাজার ইউরিনিয়াম নিউক্লিয়র মধ্যে সাতটি হল ইউরিনিয়াম ২৩৫। বোরের সংখ্যা অনুযায়ী এই দুস্প্রাপ্য ইউরিনিয়াম ২৩৫ আইসোটোপই বিদারণীয়। একটা নিউট্রন ইউরিনিয়াম ২৩৫ আইসোটোপের মত বিজোড় ভর সংখ্যা যুক্ত নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করলে সেটা জোড় ভর সংখ্যায় পরিনত হবে এবং ভেঙ্গে দু’খন্ড হবে। অবরুদ্ধ নিউট্রন যদি জোড় ভর সংখ্যাকে বিজোড় ভর সংখ্যায় পরিনত করে তাহলে ঐ নিউট্রনটি নিউক্লিয়াসের মধ্যেই রক্ষিত হবে এবং নিউক্লিয়াস সহজে ভাঙ্গবে না। বোরের এই তাত্ত্বিক ভবিষৎবাণী অচিরেই পরীক্ষার দ্বারা সমর্থিত হল। এটা সুস্পষ্ট ভাবে বোঝা গেল যে দুস্প্রাপ্য ইউরিনিয়াম ২৩৫ আইসোটোপই প্রধানত নিউট্রনের সাহায্যে বিদারণীয়। পরমাণু ভাঙ্গনের ওপর বোরের এই তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে।

তখনও বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়নি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ১৯৪০ সাল থেকেই তিনি ব্রিটেন ও আমেরিকায় অনুষ্ঠিত পারমানবিক অস্ত্র সংক্রান্ত সব রকম উদ্যোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৯৪৩ সালের প্রথম দিকে নাৎসী অধিকৃত স্বদেশে ডেনীয় প্রতিরোধীদের মাধ্যমে তিনি একটি পত্র পেলেন। এই পত্রটি ছিল ইংল্যান্ডের ছাদউইক কতৃক লিখিত একটি আমন্ত্রণ পত্র। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছাদউইক এই পত্রটি লিখেছিলেন। তিনি বোরকে ইংল্যান্ডে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ছাদউইক লিখেছিলেন যে পৃথিবীতে আপনার মত কোন দ্বিতীয় বিজ্ঞানী নেই যিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ মানুষের কাছে অধিক গ্রহণ যোগ্য হবেন। কয়েকটি বিষয়ে বোরের জ্ঞান যে তাদের কাজে লাগতে পারে এমন ঈঙ্গিতও ঐ চিঠিতে ছিল, যদিও বিষয় গুলি স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয় নি। বোর জানালেন যে তিনি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অপারগ। কারণ হিটলারের কবল থেকে বেরিয়ে এসে যে সব বিদেশী বিজ্ঞানী তার এখানে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের রক্ষার জন্য তার দেশে থাকা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু চিঠিতে উল্লেখিত বিষয় গুলি স্বরুপ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ছাদউইককে জানিয়েছিলেন, ‘সর্বোপরি, আমার জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী আমি নিশ্চিত যে পারমাণবিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক বিস্ময়কর আবিস্কার গুলির ভবিষৎ সম্ভাবনা উজ্বল হলেও তার আশু কোন ব্যবহার দুঃসাধ্য। ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে সাবধান করে দেওয়া হল যে তাকে এবং তার পরিবারকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। ডেনীয় প্রতিরোধীরা সে রাতেই তাকে সুইডেনে পার করে দিল। ব্যাপারটা ব্রিটেনকে জানিয়ে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এসে সুরক্ষিত এবং সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অবস্থায় রাখা হল। সেখানেই তাকে গত দুই বছরের পারমাণবিক বোমা তৈরীর অগ্রগতির বৃত্তান্ত জানানো হয়।

বর্তমান যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রভাবের ওপরই অধিকাংশ বিজ্ঞানী রাজনীতিবিদ ও সামরিক ব্যাক্তিদের চিন্তা ভাবনা কেন্দ্রীভূত ছিল। বোরের প্রতিক্রিয়া হল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। পারমাণবিক অস্ত্রের দীর্ঘ মেয়াদী ফলাফল বোর সবার আগে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। মিত্র শক্তি যদি পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে সাফল্যের দোর গোড়ায় উপনিত হয়ে থাকে তাহলে এই সাফল্য বর্তমান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে। এ ব্যাপারে প্রকৃত পক্ষে আলোচনা করার কিছু নেই। কিন্তু বোরের প্রশ্ন পরে কি ঘটবে? রাশিয়ানরাও ঐ একই অস্ত্র তৈরীর জন্য তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করবে। বোরের অভিমত হল রাশিয়ানদের এখনই এই অস্ত্র তৈরির উদ্যোগের কথা জানানো উচিত, অবশ্য খঁটিনাটি বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ না করে। অন্যথায় যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে পারস্পরিক সন্দেহ থেকে অবধারিতভাবে শুরু হবে পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা।

প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষাঃ পারমাণবিক বোমা নির্মাণের উদ্দেশ্যে ব্রিটেনের ‘টিউব এলয়েজ’ সংস্থা গঠিত হয় ১৯৪১ খৃষ্টাব্দে। আর একই উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ম্যানহাট্রান প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে। এই যে এক বছরের ব্যবধান তার মধ্যে বিশ্ব পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্র মিত্র শক্তির অন্যতম শরিক হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসরে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে পরমাণু অস্ত্র সম্বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং অধিকাংশ আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মনোভাব ছিল ‘ধরি মাছ না ছূই পানি’ এই প্রবাদ বাক্যের মত। কিন্তু হঠাৎ পার্ল হারবারে জাপানীদের কাছে পর্যদুস্ত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাবে আমুল পরিবর্তন ঘটে। তারা পারমানবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্পকে সামরিক ভিত্তিতে গ্রহণ করে এবং এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ নিয়োগ করে। যে তত্ত্বীয় ও প্রায়োগিক জটিলতার দরুণ কয়েক বছ পূর্বেও পরমাণু অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনায় অনেক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীও ছিলেন আস্থাহীন ইতি মধ্যে সেই পরিস্থিতির দ্রুত রূপান্তর ঘটেছিল। যে সব বাধা বিপত্তির কারণে এই সব প্রাথমিক দ্বিধাদ্বন্দ দেখা দিয়েছিল ম্যানহাট্রান প্রকল্প শুরুর আগেই সেই সব বাধা বিপত্তির নিরসন হয়েছিল। সুতরাং পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে সাফল্য লাভের জন্য তখন যে দুটি প্রয়োজন মুখ্য হয়ে উঠেছিল সেগুলো হল দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পর্যাপ্ত সম্পদ সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান। ব্রিটিশ সরকার এই দুটি প্রয়োজন মেটাতে সমর্থ হয় নি। ব্রিটেন যা পারে নি যুক্তরাষ্ট্র সরকার উৎসাহের সাথেই সেই কাজটি সম্পন্ন করলেন। আর এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট হল সেই বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত প্রকল্প যার নাম, 'ম্যানহাট্রান প্রকল্প'।

অনেক কাঠ খড় পোড়ানোর পর অবশেষে ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়। এখন প্রয়োজন শুধু সরেজমিনে পরীক্ষার। প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার ছদ্ননাম দেওয়া হল ট্রিনিটি। এই নাম করণ থেকেই বোঝা যায় যে ম্যানহাট্রান প্রকল্পের কর্ণধার জেনারেল গ্রোভস ও তার উপদেষ্টাদের মানবিক অন্য যে সব গুণের ঘাটতি থাকলেও রসবোধের কিন্তু অভাব ছিল না। খৃষ্টান ধর্ম মতে ট্রিনিটি শব্দের অর্থ পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্নার তিন রুপ সমন্বিত ঈশ্বর।

লস আলমাস থেকে ১২০ মাইল দুরে অবস্থিত আলামোগোরজে বিমান বেসকে এই পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসাবে অনুমোদন করলেন জেনারেল গ্রোভস। যদিও নিরাপত্তার কারণে এই স্থানটি ছিল যথেষ্ট দুরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন, তথাপি ইতরজনের বিভ্রান্তির জন্য একটি বানোয়াট কাহিনী প্রচার করা হল যে এই বিমান বেস এ সংরক্ষিত জিনিসপত্রে এক অপ্রত্যাশিত বিষ্ফোরণ ঘটে গেছে।

প্রথম পারমাণবিক বোমার জন্য প্রয়োজনীয় প্লটোনিয়াম জুলাই মাসের প্রথমেই লস এলামসে পৌছে ছিল। ১২ জুলাই দুপুরে মহামুল্যবান এই বস্তুটিকে আলামোগোরডোতে স্থানান্তর করা হয়। কয়েক ঘন্টা পরেই অপারমাণবিক অংশ সমুহকে বহন করে এক সারি গাড়ির মিছিল গন্তব্য স্থলের দিকে রওনা হল। গন্তব্য স্থানটি হল সেই জনমানব শূণ্য মরু অঞ্চল যেখানে এই উদ্দেশ্যে একটি ১০০ ফুট ধাতব টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল। এই টাওয়ারের গোড়ায় স্থাপিত একটি তাবুর মধ্যে পরদিন বিচ্ছিন্ন অংশ সমুহকে যথাযথ ভাবে সন্নিবিষ্ট করা হল। সন্ধ্যার মধ্যেই সব কিছুর প্রস্ততি সম্পর্ণ হল, বাকি রইল শুধু বিষ্ফোরক সলতেটি ঢোকানো।

পরের দিন সকালে বোমাটিকে টাওয়ারের উপর একটি প্ল্যাটফর্মে উত্তোলন করা হল। বিকাল ৫টার মধ্যে সব প্রস্ততি সমাপ্ত হল। পরীক্ষার সময় নির্ধারিত হল ১৬ জুলাই সূর্যোদয়ের সাড়ে চার ঘন্টা পূর্বে অর্থাৎ রাত আড়াইটার সময়। ১৫ জুলাই মধ্য রাত্রির কিছু পূর্বে এই সময় পরিবর্তন করা হয়। রাত তিনটার সময় গ্রোভস এবং ওপেনহাইমার লক্ষ্য করলেন যে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। যার কারণে সময় আবারও পিছিয়ে দিলেন। সময় চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হল সকাল সাড়ে পাঁচটা অর্থাৎ সূর্যোদয়ের এক ঘন্টা আগে। যে পাঁচ জন লোক টাওয়ারে বসে শেষ মুহূর্তের কাজ গুলি সমাধা করছিলেন তাদেরকে সকাল পাঁচটায় স্থান ত্যাগ করার জন্য আদেশ দেওয়া হল। প্রত্যেকেই তারা নেমে এসে নিজ নিজ গাড়িতে চড়ে বিপজ্জনক এলাকা ত্যাগ করলেন। টাওয়ার এবং তার উপরে অবস্থিত বস্তুটি আলোকিত করার জন্য বিরাট ফ্লাডলাইট জ্বালানো হল। টাওয়ার থেকে মাত্র সতের হাজার গজ দূরে অবস্থিত মূল শিবির। জেনারেল গ্রোভস এই শিবিরে ফিরে আসার দশ মিনিট পর চূড়ান্ত গণনা শূরু হল। সময়ের ব্যবধান যতই কমতে লাগল মিনিট থেকে এসে সেকেন্ডে ঠেকল, আশঙ্কা উদ্বেগের পরিমাণ সেই তালে লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রুত লয়ে বাড়তে লাগল। নিমিষের মধ্যে যা ঘটতে যাচ্ছে তার প্রলঙ্করের সম্ভাবনা সম্বন্ধে এই শিবিরের সকলেই সচেতন ছিলেন। বিজ্ঞানীরা অনুভব করছিলেন যে তাঁদের হিসাব নিকাস সঠিক, আর বোমাটির বিস্ফোরণ তাই অবধারিত। কিন্তু একই সাথে প্রত্যেকের মনের গহনে বেশ জোরালো সন্দেহও লুকিয়ে ছিল। রেডিওতে গণনা যখন ১০, ৯, ৮ এ ভাবে শূণ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন একটি খুঁটিতে ভর করে তিনি কাঠের মত নিশ্চপ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিস্তব্ধ ঘরটিতে 'এখন' শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই কয়েকটি মধ্যাহ্ন সূর্যের আলোর সমান দ্বীপ্তিতে বিদ্যুৎ চমকের মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো গোটা মরুভুমি, প্রায় দু’শ মাইল পর্যন্ত দেখা গেল জলন্ত বহ্নিশিখার আলো।


এটার রঙ সোনালী, রক্তবর্ণ, বেগুনী, ধুসর এবং নীল। এই আলো নিকটবর্তী পর্বতমালার প্রতিটি শৃঙ্গ, শৈলশিরা এবং তুষারস্তুপের ফাটলকে এমন সুস্পষ্ট ও সুষমার সাথে প্রদীপ্ত করেছিল যা অবর্ণনীয়। প্রত্যক্ষ দর্শনেই যা শুধু কল্পনীয়। মহান কবিরা যে সৌন্দর্যের শুধু স্বপ্ন দেখেছিলেন, এ সেই সৌন্দর্য। কিন্তু তাদের বর্ণনায় এ সৌন্দর্যের রুপ ধরা পড়ে নি। পৃথিবীর এই প্রথম পারমাণবিক বিষ্ফোরণ প্রত্যক্ষ করতে যে সব বিজ্ঞানীরা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবারই মোটামুটি একই ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ওপেনহাইমার স্মৃতিচারণ করেছেন, “উপস্থিত ব্যক্তিদের কেউ কেউ হেসেছিলেন, কয়েক জন কেঁদে ফেলেছিলেন, তবে বেশীরভাগ ছিলেন স্তব্ধ। পরবর্তী কয়েক ঘন্টায় সংগৃহীত উপাত্ত থেকে জানা গেল যে রকমটি আশা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশী জোড়ালো হয়েছে বিষ্ফোরণ। গ্রোভস সমরমন্ত্রী স্টিমসনকে জানালেন যে ১৫০০০ থেকে ২০০০০ টন টি.এন.টি এর সমতুল্য বিষ্ফোরণ ঘটেছে। যে ইস্পাতের টাওয়ারটির সাথে বোমাটি বেধেঁ দেওয়া হয়েছিল সেটি প্রচন্ড উত্তাপে বাষ্পীভূত হয়ে গেছে।

লেখকঃ ডাঃ নাসির।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

৬টি মন্তব্য:

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info