প্রাচীন সভ্যতা টিউওয়ানাকু


মিশরীয় সভ্যতা, ইনকা সভ্যতাসহ প্রাচীন পৃথিবীর এমন কিছু নমুনা এখনও টিকে আছে যা দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। চোখ জুড়ানো সব এসব সভ্যতা সেই প্রাচীন সময়েও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে ছিল অনেক উন্নত। বেশিরভাগ মানুষ এসব নিদর্শনের সৌন্দর্য দেখেই তৃপ্ত হয়ে যান, খুব গভীরে যেতে চান না। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই এসব সভ্যতায় খুব বিভ্রান্তিকর কিছু চিহ্ন পাওয়া যায়, যা দেখে মনে হতে পারে, এসব সভ্যতা গড়ে তোলার পেছনে ছিল মানুষ ছাড়াও অন্য কোনও বুদ্ধিমান প্রাণীর হাত। হ্যাঁ, এলিয়েনদের উপস্থিতির কথা চিৎকার জানান দেয় এসব সভ্যতার কিছু নিদর্শন, যা লক্ষ্য না করাটাই অস্বাভাবিক। বলিভিয়ার টিউওয়ানাকু এমনই কিছু চিহ্ন ধারন করে রেখেছে যুগ যুগ ধরে।

টিউওয়ানাকুর ব্যাপারে জানার আগে আপনাকে প্রথমে পেরুর নাজকা লাইনের ব্যাপারে কিছু প্রাথমিক তথ্য জেনে রাখতে হবে। পেরুর নাজকা অঞ্চলের মরুর মাটিতে প্রাচীন কিছু রেখাচিত্র রয়েছে, যা মানুষকে কৌতূহলী করে রেখেছে অনেক দিন ধরে। অনেকে অনেক জল্পনা কল্পনা করেন এই নাজকা লাইন নিয়ে। খুব যত্ন করে আঁকা এসব রেখাচিত্র এত বড় যে মাটি থেকে এদের অবয়ব বোঝা যায় না। কিন্তু আকাশ থেকে দেখলে বোঝা যায় এরা কতটা নিখুঁত করে, হিসেব কষে আঁকা। মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, সে সময়ে তো মানুষ আকাশে উড়তে জানত না, বিমান বা প্যারাসুট জাতীয় কিছু ছিল না। তবে কাদের জন্য এগুলো আঁকা হয়? অনেকের মতে, সে সময়ে নাজকার ইনকা সভ্যতার মানুষের সাথে এলিয়েনদের যোগাযোগ ছিল। সম্ভবত তারাই এসব লাইন এঁকে রেখে যায়। আরেকটি ধারণা হলো, এলিয়েনরা চলে যাবার পর মানুষ এসব রেখাচিত্র তৈরি করে, যাতে আকাশ থেকে এগুলো দেখে এলিয়েনরা ফিরে আসে।


এই ব্যাখ্যা শিশুতোষ মনে হতে পারে অনেকের কাছেই। তাদেরকে আরেকটু বিভ্রান্ত করে দেবার জন্য নাজকার রেখাচিত্রগুলোর বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। বেশ কিছু রেখাচিত্র দেখে বোঝা যায় এরা হলো বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব। কিন্তু কিছু খটকা থেকে যায়। যেমন একটি বিশাল প্রাণীর চিত্র আছে যার শরীর থেকে হাতের মতো দুটি অঙ্গ বের হয়ে এসেছে। একটি বানরের মতো প্রাণীর চিত্র আছে, আছে একটি মাকড়সার ছবি যার সব কয়টি পা একই রকম হলেও একটি পা বাঁকানো। যত্ন করে, সময় এবং শ্রম দিয়ে আঁকা ছবির এই ত্রুটিগুলো নিশ্চয়ই ইচ্ছাকৃত। আর যদি তাই হয়, তবে তারা কি অর্থ বহন করে। সবচাইতে বিভ্রান্তিকর হলো একটি মানুষের মত অবয়ব, যাকে দেখে মনে হয় সে মহাকাশচারীর মতো স্পেসস্যুট পড়ে আকাশের দিকে হাসিমুখে হাত নাড়াচ্ছে!

নাজকা লাইনের সাথে এলিয়েনের যোগসূত্র নিয়ে এমন অনেক যুক্তি দেওয়া যায়, কিন্তু আজ আমরা টিউওয়ানাকু নিয়ে জানবো। নাজকার সাথে কি সম্পর্ক টিউওয়ানাকুর? নাজকা লাইনের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতি এবং অনেক সরল এবং বক্র রেখা। এসব রেখা এতই নিখুঁত এবং নিরবিচ্ছিন্ন যে মনে হয় মাটিতে স্কেল ফেলে এগুলো আঁকা। মাইলের পর মাইল এসব রেখা চলে গেছে। পাহাড়ের ওপর নিচ করে চলে গেছে এই রেখা। কিন্তু পাহাড় এড়িয়ে বা পাহাড়ের পাশ দিয়ে কি এগুলো আঁকা যেতো না? কিন্তু তা করা হয়নি। যত দুর্গম এলাকাই হোক না কেন, এই সরল রেখা অব্যাহত থেকেছে। এর ব্যাখ্যা এভাবে দেওয়া যেতে পারে, এই সরলরেখা কোনও বিশেষ দিক নির্দেশ করছে। আকাশ থেকে দেখে এলিয়েনরা যাতে পথ চিনে যেতে পারে, সে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে এসব সরলরেখা। এসব সরলরেখা দিয়ে তৈরি অনেক সুচালো মাথার ট্রাপিজয়েড দেখা যায়, যা সরাসরি নির্দেশ করে টিউওয়ানাকুর দিকে।


এতসব জায়গা থাকতে কেন টিউওয়ানাকুর দিকে যাবে এলিয়েনরা? এখানে লক্ষ্য করতে হবে নাজকা আর টিউওয়ানাকুর প্রাচীন “দেবতা”দের মিল। নাজকার সভ্যতা এবং টিউওয়ানাকুর সভ্যতা ছিল সমসাময়িক। টিউওয়ানাকু থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণে অবস্থিত হলো নাজকা উচ্চভুমি। টিউওয়ানাকুর মানুষের বিশ্বাস ছিল এক আকাশ দেবতার উপরে। সেই আকাশ দেবতার ছবি পাওয়া যায় নাজকা সভ্যতার মৃৎপাত্রে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই আকাশ দেবতার মাথায় ছিলো মহাকাশচারীর মতো হেলমেট! ধারণা করে নেওয়া হয় টিউওয়ানাকু এবং নাজকার এই আকাশ দেবতা একই অস্তিত্ব। মহাকাশচারীর হেলমেট ছাড়াও এই দেবতার শরীরের আকৃতি দেখা যায় অন্যরকম। মানুষের মাথার সাথে মাছের দেহ জুড়ে দিয়ে চিত্রশিল্পীরা বোঝাতে চেয়েছেন, এই অস্তিত্বের উচ্চ মাত্রার বুদ্ধিমত্তা আছে। আর শুনতে অবাস্তব বলে মনে হলেও, টিউওয়ানাকু আর নাজকার কিছু কিছু ছবিতে দেখা যায়, এই আকাশ দেবতার হাতে থাকা যন্ত্রের সাথে লাগানো রয়েছে লাউডস্পিকার!

টিউওয়ানাকু আর নাজকার রেখাচিত্রের মাঝে আরও অনেক মিল পাওয়া যায় যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় দূরে দূরে অবস্থিত এই দুই জনপদের মাঝে কোনও রকমের সংযোগ ছিলো। নয়তো এদের মাঝে এই মিলের আর কোনও কারণ নেই। যেমন দুই এলাকাতেই রেখাচিত্রের মাঝে স্পাইরাল বা ঘূর্ণির যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা যায়, যা তাদের আকাশ দেবতার স্পাইরাল পথে আকাশ থেকে নেমে আসার চিহ্ন। দেখা যায় আকাশ দেবতা এবং বিভিন্ন প্রাণীর চার-আঙ্গুল বিশিষ্ট ছবি।

এই আকাশ দেবতার অবয়বের দিকে লক্ষ্য করলে কিছু খুঁটিনাটি পাওয়া যায়। যেমনঃ তার দুই হাতে উঁচু করে তুলে ধরা এক যন্ত্র, যা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। ধারণা করা হয় এই যন্ত্র আকাশ দেবতার শরীরের আশেপাশে মহাকর্ষ বল নিষ্ক্রিয় করে দিতে সাহায্য করে, কারণ একই ছবিতে দেখা যায় এই আকাশ দেবতার মাছের মতো লেজ আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি চিতাবাঘের মাথার মতো কিছু যন্ত্র দেখে বোঝা যায়, আকাশে যাত্রা করার সময় গর্জনের মতো শব্দ নির্দেশ করা হয়েছে এর দ্বারা। আর এর শরীরের বিভিন্ন অংশে পাখির মাথার মতো প্রতীক থেকে ধারণা করা হয়, এর ওড়ার ক্ষমতা ছিল এবং তার জন্য কোনও রকমের মহাকাশযান হয়তো তার দরকার পড়তো না। নিজের শরীরে লাগানো এসব যন্ত্রের সাহায্যেই সে উড়তে পারতো।


প্রাচীন সময়ে টিউওয়ানাকুর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের আরেকটি নিদর্শন হল পুমা পামকু/পানকু। টিউওয়ানাকুর মন্দিরের একটি অংশ এই পুমা পানকু। পাথরে তৈরি এই কাঠামো এত উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি যে আজটেক সভ্যতার নিদর্শনকেও তা হার মানিয়ে দেয়। অনেক টন ওজনের পাথরের ব্লক দিয়ে এটি তৈরি। এমন সময়ে এটি তৈরি হয়েছে যখন ওই অঞ্চলে ঘোড়ার ব্যবহার শুরু হয়নি। তাহলে ১০-৫০ মাইল দূরের পাথুরে কোয়ারি থেকে এগুলোকে বয়ে আনা হলো কিভাবে? এখানেই শেষ নয়। এসব পাথর এত সুন্দরভাবে খাঁজ কাটা যে একটি আরেকটির সাথে আটকে থাকে। কিন্তু এই পাথরে কোনও রকমের বাটালি বা যন্ত্রপাতির দাগ নেই। তবে এদেরকে কাটা হয়েছিলো কিভাবে? এমন কোনও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিলো যাতে কোনও রকমের দাগ ছাড়াই পাথর কেটে ফেলা সম্ভব হতো? এই প্রযুক্তি তারা পেলো কোথা থেকে?

অনেক প্রশ্ন রয়েছে টিউওয়ানাকু ঘিরে, রয়েছে অনেক বিভ্রান্তি। কিন্তু নাজকা লাইন আর টিউওয়ানাকুর এই রহস্যময় সভ্যতা পরতে পরতে যে এলিয়েন অস্তিত্বের প্রমাণ লুকিয়ে আছে, তা অস্বীকার করা শক্ত। সময়ই বলে দেবে এসব প্রতীক কি আসলেই এলিয়েন অস্তিত্ব নির্দেশ করে, নাকি তা ছিল নেহায়েতই টিউওয়ানাকুর মানুষের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।

লেখকঃ কে এন দেয়া।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info