২০১২ সাল। থাইল্যান্ড। একজন ব্রিটিশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয় সাথে কিছু আগুনে ঝলসানো মানব ভ্রূণ রাখার অপরাধে, যেগুলো ছিল স্বর্ণ দিয়ে তৈরি পাতলা পাতে আগাগোড়া মোড়ানো। বিস্তারিত অনুসন্ধানে জানা যায় যে সেই হতভাগ্য শিশুগুলো পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার আগেই ব্ল্যাক ম্যাজিকের করুণ শিকারে পরিণত হয়েছে। রাজধানী ব্যাঙ্ককের চায়না টাউন ডিস্ট্রিক্টের একটি হোটেলে কক্ষ থেকে এই ছেলে শিশু ভ্রূণগুলোকে একটি স্যুটকেসের ভেতর পাওয়া যায়।
'চৌ হোক কুয়েন' নামে ২৮ বছর বয়সী এই তরুণের কাছে ছিল ব্রিটিশ পাসপোর্ট, কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন তাইওয়ানের অধিবাসী। তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করেন যে বেশ কিছুদিন আগে ৪০০০ পাউন্ডের বিনিময়ে তিনি আরেকজনের কাছ থেকে ভ্রূণ গুলো কিনে নেন। যদিও প্রথম কোথা থেকে ভ্রূণ গুলো খোয়া যায় বা কাদের শিশু এরা সেই তথ্য এখনো অজানা। কুয়েন আরো জানান যে তিনি সেগুলো তাইওয়ানে নিয়ে যাচ্ছিলেন কালোবাজারে বিক্রি করে দেয়ার জন্য। তাইওয়ানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রায় ৬ গুণ বেশি দামে বিক্রি হয় এইসব ভ্রুন। যারা ক্রয় করেন তাদের ধারণা এসব ভ্রূণ সংগ্রহ করলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় ও যার কাছে থাকে সে ঐশ্বর্যশালী হয়ে উঠে। কুয়েন আরো জানান যে তাকে 'কুন ইচেন' নামে আরেকজন তাইওয়ানিজ ব্যক্তি এই কাজের জন্য ভাড়া করে। সে লোকটি নিজেও প্রায়ই থাইল্যান্ডে যেতো ব্ল্যাক ম্যাজিকের জন্য প্রয়োজনীয় মানব ভ্রূণ সংগ্রহ করতে।
প্রাচীন থাই পান্ডুলিপিতে চীনা সম্প্রদায়ের মানুষদের ভ্রূণের উপাসনার কথা উল্লেখ রয়েছে, যেটা ‘কুমান থং’ নামে পরিচিত। তখন থেকে এখন পর্যন্ত সেখানকার অনেক মানুষের বিশ্বাস মানব ভ্রূণ শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসে। বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে তাই ব্যবসার জন্য বিক্রি হয় মানব ভ্রূণ। প্রথমে হাতুড়ে ডাক্তারের মাধ্যমে গোপনে এসব ছেলে শিশুর ভ্রূণ তাদের মায়েদের পেট থেকে অপসারণ করা হয়। এরপর এর উপর জাদুমন্ত্র উচ্চারণ ও অন্যান্য রীতি পালন করে স্বর্ণের পাতা দিয়ে আবৃত করে দেয়া হয়। ‘কুমান থং’ এর অর্থ হচ্ছে “golden baby boy”। পুরাকাহিনী অনুসারে, কেউ যদি এই ভ্রূণকে সম্মান প্রদর্শন করে তবে কোন বিপদ উপস্থিত হলে সেটা তার মালিককে সতর্ক করে দেবে ও মালিকের সুরক্ষায় নিয়োজিত হবে। ব্যবহারিকভাবে অনেক সময় ভ্রূণ পাওয়া না গেলে কাঠের তৈরি ভ্রূণের উপাসনাও করা হয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জন্য হোটেল কক্ষে এক ভয়াবহ দৃশ্য অপেক্ষা করছিল। বিকৃত ও ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রয়োগ করা মানব সন্তানদের ভ্রূণ! হতভাগ্য ছেলে শিশুদের ভ্রূণ গুলোতে বিভিন্ন ধরণের ব্ল্যাক ম্যাজিক চিহ্ন ও মন্ত্রপূত সূতো বাঁধা ছিল। থাইল্যান্ডে গর্ভপাত ঘটানো আইনত নিষিদ্ধ। তবে ধর্ষণ, অবৈধ সম্পর্ক বা গর্ভবতী মায়েদের সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে মৃত্যু ঝুঁকি সৃষ্টি হলে গর্ভপাত ঘটানো সেদেশে বৈধ। আর সেভাবেই এই ভ্রূণ গুলোকে সংগ্রহ করা হয়। কুয়েনকে ভ্রূণ বহন করার অপরাধে কারাদন্ড ও জরিমানা করা হয়। এর আগে ২০১১ সালে থাইল্যান্ডের দু'জন শববাহক ও একজন নারীকে অবৈধ ক্লিনিকে গর্ভপাত করানো ভ্রূণ সংগ্রহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। এর আগেই একটি মঠের মর্গ থেকে প্রায় ২০০০ মানব ভ্রূণ উদ্ধার করা হয়, যেগুলোকে আগুনের ঝলসানোর জন্য জমা করা হয়েছিল!
বৌদ্ধ মন্দিরটিতে পুলিশ, স্বাস্থ্য কর্মী ও দাতব্য সংস্থার মানুষজন তদন্ত শুরু করলে তাদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত করে একের পর এক রশি দিয়ে বাঁধা সাদা ব্যাগ বের হতে শুরু করে। এগুলো মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিল, সব গুলোর ভেতর ছিল মানব ভ্রূণের অবশিষ্টাংশ। দীর্ঘ এক বছর ধরে এগুলোকে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। অন্যান্য দেশের মতো থাইল্যান্ডেও অকাল গর্ভপাত একটি বড় সমস্যা। এ ধরণের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে কোনো সামাজিক স্বীকৃতি পায় না, তাই জন্মের আগেই তাদের করুণ পরিণতি ঘটে। আর এটারই ফায়দা লুটছে এক শ্রেণীর মানুষ যারা ব্ল্যাক ম্যাজিকের নামে এই ভ্রূণ গুলো সংগ্রহ করছে আর বিক্রি করছে চড়া দামে। অনেকে অভাবের তাড়নায় নিজেদের অনাগত সন্তান বা ভ্রূণ বিক্রি করে দেয়ার ঘটনাও কম নয়। ভ্রূণ গুলো যাতে পচে না যায় সেজন্য বিশেষ ধরণের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে এদেরকে সজীব রাখা হয় ও এদের ভেতরে মোম ঢুকিয়ে এদের আকৃতি ঠিক রাখা হয়। ব্ল্যাক ম্যাজিক অনুসারীদের সাথে হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মচারীদের আঁতাত থাকে। হাসপাতাল থেকে এগুলো চড়া দামে বিক্রি হয় ও তার চেয়েও চড়া দামে ক্রেতারা এসব ভ্রূণ কিনে নেন সৌভাগ্য লাভের আশায়।
যারা ভ্রূণের ব্যবসা করে তারা দু'ভাবে লাভবান হয়। এক, ব্ল্যাক ম্যাজিকে বিশ্বাসীদের কাছে উচ্চ দামে এসব ভ্রূণ বিক্রি করা হয়। দুই, স্বর্ণ চোরাচালানকারীরা স্বর্ণ গলিয়ে ভ্রূণের ভেতরে নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাচার করে। যেহেতু এসব ভ্রূণের উপর ধর্মীয় বাণী লিখিত থাকে তাই অনেকেরই মনে এগুলো নিয়ে কোন সন্দেহ জাগে না।
লেখকঃ জানা অজানার পথিক।
যারা ভ্রূণের ব্যবসা করে তারা দু'ভাবে লাভবান হয়। এক, ব্ল্যাক ম্যাজিকে বিশ্বাসীদের কাছে উচ্চ দামে এসব ভ্রূণ বিক্রি করা হয়। দুই, স্বর্ণ চোরাচালানকারীরা স্বর্ণ গলিয়ে ভ্রূণের ভেতরে নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাচার করে। যেহেতু এসব ভ্রূণের উপর ধর্মীয় বাণী লিখিত থাকে তাই অনেকেরই মনে এগুলো নিয়ে কোন সন্দেহ জাগে না।
লেখকঃ জানা অজানার পথিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন