গাছেরও যে অনুভূতি আছে, তাদেরকে আঘাত করলে বা আদর করলে তারা যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, আঘাত করলে ওরাও ব্যথা পায়, সেটা প্রথম কে প্রমাণ করেছিলেন, বলেন তো? আমাদের দেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। তাকে সবাই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু নামেই চেনে। এমনি এমনিই কিন্তু তার নাম আচার্য হয়নি, বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার রয়েছে অসামান্য অবদান। আর আইনস্টাইনকে চেনেন না, সেই যে ঝাঁকড়া চুলের আত্মভোলা বিজ্ঞানী? তিনি তো তার সম্পর্কে বলেছেন, জগদীশচন্দ্র বসু ‘বিরাট এক বিজ্ঞানী’। ভাবছেন, এতোদিন পরে হঠাৎ তাঁর গল্প করতে শুরু করলাম কেনো? আরে, ৩০ নভেম্বর যে তাঁর জন্মদিন!
জগদীশচন্দ্র বসু কিন্তু খুব বড়ো মাপের একজন বিজ্ঞানী। বাঙালিদের মধ্যে তার মতো বড়ো বিজ্ঞানীর নাম করতে হলে এক সত্যেন বসুর নামই বলা যায়। সত্যেন বসুর নাম শোনেননি? তাঁর সবচেয়ে বড়ো অবদান হলো ‘বোস-আইনস্টাইন তত্ত¡’; নাম শুনেই তো বুঝেছেন, আইনস্টাইনের সাথে মিলে তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি কতো বড়ো বিজ্ঞানী তা বোঝাতে আরো কিছু বলতে হবে? এই সত্যেন বসুও কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুরই ছাত্র ছিলেন।
তবে বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য কিন্তু তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ছোটোবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি তার খুব ঝোঁক ছিলো। তিনি ছিলেন যেমন শান্তশিষ্ট, জানার ব্যাপারে তেমনই জেদী। কোনো কিছু জানার আগ্রহ হলে তার জন্য সবকিছু করতেন তিনি। তিনি যে কত্তো গবেষণা করেছেন! তার সবগুলোই যে সফল হয়েছেন, তা কিন্তু নয়; অনেক গবেষণাতেই তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। সাফল্যে তিনি যেমন আনন্দিত হতেন, ব্যর্থ হলে কিন্তু মোটেও দমে যেতেন না। তার কাছে মনে হতো সাফল্য ব্যর্থতা বড়ো নয়, জানার চেষ্টা করে যাওয়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একই রকম কথা বলতেন আধুনিক অলিম্পিকের জনক ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তো, তিনি বলতেন, জয় পরাজয় নয়, অংশগ্রহণই বড়ো কথা। আবার ম্যাক্সিম গোর্কির নাম শুনেছেন না, বিখ্যাত রুশ লেখক? তিনি তাঁর ৩ খণ্ডের বিশাল আত্মজীবনীর এক জায়গায় লিখেছেন, কোনো কিছুর ফলাফল নয়, তার রূপায়ণের প্রক্রিয়াটাই আমাকে বেশি আনন্দ দেয়। মানে, তাঁর কাছেও ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, বরং জানাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন বিজ্ঞানী, তাই তিনি সারাদিন নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বেড়াতেন। আর ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন জাত সাহিত্যিক, তাই তিনি সারাদিন মানুষ আর পশুপাখিদের খুব করে খেয়াল করতেন, কে কী করে, কিভাবে করে।
তো বলছিলাম আমাদের বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর গল্প। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর, ময়মনসিংহ শহরে। তার বাবার নাম ভগবানচন্দ্র বসু, মায়ের নাম বামা সুন্দরী। জগদীশচন্দ্রের পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ভগবানচন্দ্র বসুর তখন ফরিদপুরে চাকরি করেন। ছেলে জগদীশচন্দ্র বসুকে প্রথম ভর্তি করা হয় ওই শহরেরই একটি বাংলা স্কুলে। তখন অভিজাতদের মধ্যে ছেলেমেয়েকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করানোর প্রবণতা ছিলো এখনকার চেয়েও বেশি, তখন যে ইংরেজদেরই রাজত্ব চলছিলো। ভগবানচন্দ্র বসু কিন্তু আবার সব সময়ই মাতৃভাষার প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তাই তো ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলেন বাংলা স্কুলে। আর ওই স্কুলে জগদীশের সহপাঠীরা প্রায় সবাই ছিল সাধারণ দরিদ্র ঘরের সন্তান। তাদের সঙ্গে মিশে, খেলাধুলা করতে করতেই শিশু জগদীশের মনে প্রকৃতি, গাছপালা আর কীটপতঙ্গ নিয়ে তৈরি হলো আগ্রহ। তা নইলে কি আর তিনি গাছের প্রতিক্রিয়ার সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার করতে পারেন!
জগদীশচন্দ্র বসু কিন্তু খুব বড়ো মাপের একজন বিজ্ঞানী। বাঙালিদের মধ্যে তার মতো বড়ো বিজ্ঞানীর নাম করতে হলে এক সত্যেন বসুর নামই বলা যায়। সত্যেন বসুর নাম শোনেননি? তাঁর সবচেয়ে বড়ো অবদান হলো ‘বোস-আইনস্টাইন তত্ত¡’; নাম শুনেই তো বুঝেছেন, আইনস্টাইনের সাথে মিলে তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি কতো বড়ো বিজ্ঞানী তা বোঝাতে আরো কিছু বলতে হবে? এই সত্যেন বসুও কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুরই ছাত্র ছিলেন।
তবে বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য কিন্তু তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ছোটোবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি তার খুব ঝোঁক ছিলো। তিনি ছিলেন যেমন শান্তশিষ্ট, জানার ব্যাপারে তেমনই জেদী। কোনো কিছু জানার আগ্রহ হলে তার জন্য সবকিছু করতেন তিনি। তিনি যে কত্তো গবেষণা করেছেন! তার সবগুলোই যে সফল হয়েছেন, তা কিন্তু নয়; অনেক গবেষণাতেই তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। সাফল্যে তিনি যেমন আনন্দিত হতেন, ব্যর্থ হলে কিন্তু মোটেও দমে যেতেন না। তার কাছে মনে হতো সাফল্য ব্যর্থতা বড়ো নয়, জানার চেষ্টা করে যাওয়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একই রকম কথা বলতেন আধুনিক অলিম্পিকের জনক ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তো, তিনি বলতেন, জয় পরাজয় নয়, অংশগ্রহণই বড়ো কথা। আবার ম্যাক্সিম গোর্কির নাম শুনেছেন না, বিখ্যাত রুশ লেখক? তিনি তাঁর ৩ খণ্ডের বিশাল আত্মজীবনীর এক জায়গায় লিখেছেন, কোনো কিছুর ফলাফল নয়, তার রূপায়ণের প্রক্রিয়াটাই আমাকে বেশি আনন্দ দেয়। মানে, তাঁর কাছেও ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, বরং জানাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন বিজ্ঞানী, তাই তিনি সারাদিন নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বেড়াতেন। আর ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন জাত সাহিত্যিক, তাই তিনি সারাদিন মানুষ আর পশুপাখিদের খুব করে খেয়াল করতেন, কে কী করে, কিভাবে করে।
তো বলছিলাম আমাদের বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর গল্প। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর, ময়মনসিংহ শহরে। তার বাবার নাম ভগবানচন্দ্র বসু, মায়ের নাম বামা সুন্দরী। জগদীশচন্দ্রের পিতা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ভগবানচন্দ্র বসুর তখন ফরিদপুরে চাকরি করেন। ছেলে জগদীশচন্দ্র বসুকে প্রথম ভর্তি করা হয় ওই শহরেরই একটি বাংলা স্কুলে। তখন অভিজাতদের মধ্যে ছেলেমেয়েকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করানোর প্রবণতা ছিলো এখনকার চেয়েও বেশি, তখন যে ইংরেজদেরই রাজত্ব চলছিলো। ভগবানচন্দ্র বসু কিন্তু আবার সব সময়ই মাতৃভাষার প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তাই তো ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলেন বাংলা স্কুলে। আর ওই স্কুলে জগদীশের সহপাঠীরা প্রায় সবাই ছিল সাধারণ দরিদ্র ঘরের সন্তান। তাদের সঙ্গে মিশে, খেলাধুলা করতে করতেই শিশু জগদীশের মনে প্রকৃতি, গাছপালা আর কীটপতঙ্গ নিয়ে তৈরি হলো আগ্রহ। তা নইলে কি আর তিনি গাছের প্রতিক্রিয়ার সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার করতে পারেন!
জগদীশচন্দ্রের ছেলেবেলা কেটেছে এক ভয়ঙ্কর ডাকাতের সঙ্গে। সেই ডাকাতটি আবার যে সে ডাকাত ছিলো না, রীতিমতো জেলখাটা ঘাগু ডাকাত! জেলফেরত ডাকাতটি অবশ্য তার বন্ধু বনে গিয়েছিলো। সে ঘটনাটিও বেশ মজার। জগদীশ চন্দ্রের বাবা জেলফেরত এই ডাকাতকে ভালো হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। আর ছোটো জগদীশের সংস্পর্শে এসে সেই ডাকাতটিও এক্কেবারে ভালো মানুষটি হয়ে গিয়েছিলো। ডাকাতটির দায়িত্ব ছিলো জগদীশ চন্দ্রের দেখাশোনা করার। আর জগদীশের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই যেনো ডাকাতটির স্বভাব বদলে একেবারে ছোট্টো ছেলেদের মতো হয়ে গেলো! এমনই ভালো ছিলেন আমাদের জগদীশচন্দ্র। আর তখন তো শিশু জগদীশ প্রতিদিন ডাকাত সর্দারের কাঁধে জাঁকিয়ে বসে স্কুলে যাওয়া-আসা করতেন! আর যাওয়া-আসার পথে কতো যে গল্প শুনতেন। সব সেই জেলখাটা ঘাগু ডাকাতের ডাকাতির রোমহর্ষক গল্প।
খেলাধুলার ব্যাপারেও জগদীশের খুব আর্কষণ ছিলো। এমনকি ফরিদপুরে তার একটি ক্রিকেট দলও ছিল। আবার তাঁর বাবা একবার তাকে একটি টাট্টু ঘোড়া কিনে দিয়েছিলেন। আর সেই বয়সেই জগদীশচন্দ্র ঘোড়া চালনায় বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। কিছুদিনের মধ্যেই ফরিদপুর শহরে এক ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন স্থানীয় লোকজন। নিজের ঘোড়ায় চড়ে জগদীশ ওই প্রতিযোগিতা দেখতে গিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিলো ওই জেলখাটা ঘাগু ডাকাত। তার ছোট্টো টাট্টু ঘোড়াটিকে দেখে একজন প্রতিযোগী ঠাট্টাচ্ছলে জগদীশচন্দ্রকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। আর ছোট্টো জগদীশও সাত-পাঁচ না ভেবে রাজি হয়ে যান। এর আগে কখনও জগদীশ কোনো ঘোড়দৌড়ে অংশগ্রহণ করেন নি। তবু প্রতিযোগিতায় নেমে তিনি মোটেও ভয় পেলেন না। একবারও না থেমে তিনি দৌড় শেষ করলেন; অবশ্য পৌছলেন সবার শেষে। এমনিতেই তিনি কখনো ঘোড়দৌড় করেননি, তার উপর তাঁর ঘোড়া তো টাট্টু ঘোড়া, গায়ে-গতরে ছোটোখাটো। তবু তিনি কেনো অংশ নিয়েছিলেন? ঐ যে, তার নীতিই তো ছিলো, সাফল্য-ব্যর্থতা বড়ো নয়, চেষ্টা করে যাওয়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তার এ ভাবনাটা বড়ো হয়েও ছিলো। তিনি যখন অনেক বড়ো একজন বিজ্ঞানী হয়ে গিয়েছিলেন, তখনও তিনি বিজ্ঞানের জন্য কাজ করেই খুশি থাকতেন, বিজ্ঞানের জন্য কাজ করাতেই ছিলো তার আনন্দ। যেমন তাঁর রেডিও আবিষ্কারের ঘটনাটিও ধরেন না। রেডিও এর কাজ করার মূলনীতি মার্কনির মতো তিনিও আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু ঘটনাক্রমে নাম হলো মার্কনির। তিনি তখন হতাশ না হয়ে বরং বিজ্ঞানের অন্য জায়গায় কাজ করতে শুরু করলেন। আর তার এসব সাফল্য-ব্যর্থতা আর সুখ-দুঃখের কথা তিনি লিখতেন তাঁর বন্ধু, আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে; চিঠিতে বন্ধুর সাথে কতো কিছুই না ভাগাভাগি করতেন। জানেন না বুঝি, আমাদের কবিগুরু যে তাঁর খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।
জগদীশচন্দ্রের বয়স যখন দশ বছর, অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার হিসেবে বাবা ভগবানচন্দ্র বদলি হলেন বর্ধমানে। তখন পর্যন্ত বর্ধমান ছিল খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেখানে দেখা দিলো ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মারা গেলো। ভগবানচন্দ্র স্বভাবতই দুঃস্থ মানুষের সেবায় নেমে পড়লেন। জগদীশচন্দ্র ভর্তি হলেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। সেখানে মাস তিনেক পড়াশোনার পর চলে গেলেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। ওখানে আবার তার সহপাঠীরা অধিকাংশই ছিল ইংরেজ সন্তান। তার ওপর ওরা সবাই কথাও বলতো ইংরেজিতে। তাই জগদীশচন্দ্রও ওদের সাথে তেমন খাতির জমাতে পারতেন না। আর ওরা এমনই দুষ্টু, প্রথমদিনই শান্তশিষ্ট জগদীশকে লাগিয়ে দিলো ক্লাসের সবচেয়ে শক্তপোক্ত ছেলেটার সঙ্গে। তবে শান্তশিষ্ট হলে কি হবে, তিনি ছিলেন খুবই সাহসী; সাহস করে লড়েছিলেন সেই শক্তপোক্ত ইংরেজ ছেলেটার সঙ্গে। সেন্ট জেভিয়ার্সের যে হোস্টেলে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখানে আবার তিনি ছিলেন সবার ছোটো। ছোটো বলে সবাই তাকে এড়িয়ে যেতো। বন্ধুর অভাব পূরণে তিনি বন্ধু হিসেবে বেছে নিলেন গাছ-গাছালিদের। হোস্টেলের আঙিনার পাশে ছোট্টো একটি বাগান করা শুরু করেন তিনি। আর হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে পশুপাখিও কিনতে শুরু করলেন। এভাবেই ছোটোবেলা থেকেই গাছ-গাছালি আর পশুপাখিদের প্রতি তাঁর অন্যরকম এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
খেলাধুলার ব্যাপারেও জগদীশের খুব আর্কষণ ছিলো। এমনকি ফরিদপুরে তার একটি ক্রিকেট দলও ছিল। আবার তাঁর বাবা একবার তাকে একটি টাট্টু ঘোড়া কিনে দিয়েছিলেন। আর সেই বয়সেই জগদীশচন্দ্র ঘোড়া চালনায় বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। কিছুদিনের মধ্যেই ফরিদপুর শহরে এক ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন স্থানীয় লোকজন। নিজের ঘোড়ায় চড়ে জগদীশ ওই প্রতিযোগিতা দেখতে গিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিলো ওই জেলখাটা ঘাগু ডাকাত। তার ছোট্টো টাট্টু ঘোড়াটিকে দেখে একজন প্রতিযোগী ঠাট্টাচ্ছলে জগদীশচন্দ্রকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। আর ছোট্টো জগদীশও সাত-পাঁচ না ভেবে রাজি হয়ে যান। এর আগে কখনও জগদীশ কোনো ঘোড়দৌড়ে অংশগ্রহণ করেন নি। তবু প্রতিযোগিতায় নেমে তিনি মোটেও ভয় পেলেন না। একবারও না থেমে তিনি দৌড় শেষ করলেন; অবশ্য পৌছলেন সবার শেষে। এমনিতেই তিনি কখনো ঘোড়দৌড় করেননি, তার উপর তাঁর ঘোড়া তো টাট্টু ঘোড়া, গায়ে-গতরে ছোটোখাটো। তবু তিনি কেনো অংশ নিয়েছিলেন? ঐ যে, তার নীতিই তো ছিলো, সাফল্য-ব্যর্থতা বড়ো নয়, চেষ্টা করে যাওয়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তার এ ভাবনাটা বড়ো হয়েও ছিলো। তিনি যখন অনেক বড়ো একজন বিজ্ঞানী হয়ে গিয়েছিলেন, তখনও তিনি বিজ্ঞানের জন্য কাজ করেই খুশি থাকতেন, বিজ্ঞানের জন্য কাজ করাতেই ছিলো তার আনন্দ। যেমন তাঁর রেডিও আবিষ্কারের ঘটনাটিও ধরেন না। রেডিও এর কাজ করার মূলনীতি মার্কনির মতো তিনিও আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু ঘটনাক্রমে নাম হলো মার্কনির। তিনি তখন হতাশ না হয়ে বরং বিজ্ঞানের অন্য জায়গায় কাজ করতে শুরু করলেন। আর তার এসব সাফল্য-ব্যর্থতা আর সুখ-দুঃখের কথা তিনি লিখতেন তাঁর বন্ধু, আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে; চিঠিতে বন্ধুর সাথে কতো কিছুই না ভাগাভাগি করতেন। জানেন না বুঝি, আমাদের কবিগুরু যে তাঁর খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।
জগদীশচন্দ্রের বয়স যখন দশ বছর, অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার হিসেবে বাবা ভগবানচন্দ্র বদলি হলেন বর্ধমানে। তখন পর্যন্ত বর্ধমান ছিল খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেখানে দেখা দিলো ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মারা গেলো। ভগবানচন্দ্র স্বভাবতই দুঃস্থ মানুষের সেবায় নেমে পড়লেন। জগদীশচন্দ্র ভর্তি হলেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে। সেখানে মাস তিনেক পড়াশোনার পর চলে গেলেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। ওখানে আবার তার সহপাঠীরা অধিকাংশই ছিল ইংরেজ সন্তান। তার ওপর ওরা সবাই কথাও বলতো ইংরেজিতে। তাই জগদীশচন্দ্রও ওদের সাথে তেমন খাতির জমাতে পারতেন না। আর ওরা এমনই দুষ্টু, প্রথমদিনই শান্তশিষ্ট জগদীশকে লাগিয়ে দিলো ক্লাসের সবচেয়ে শক্তপোক্ত ছেলেটার সঙ্গে। তবে শান্তশিষ্ট হলে কি হবে, তিনি ছিলেন খুবই সাহসী; সাহস করে লড়েছিলেন সেই শক্তপোক্ত ইংরেজ ছেলেটার সঙ্গে। সেন্ট জেভিয়ার্সের যে হোস্টেলে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখানে আবার তিনি ছিলেন সবার ছোটো। ছোটো বলে সবাই তাকে এড়িয়ে যেতো। বন্ধুর অভাব পূরণে তিনি বন্ধু হিসেবে বেছে নিলেন গাছ-গাছালিদের। হোস্টেলের আঙিনার পাশে ছোট্টো একটি বাগান করা শুরু করেন তিনি। আর হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে পশুপাখিও কিনতে শুরু করলেন। এভাবেই ছোটোবেলা থেকেই গাছ-গাছালি আর পশুপাখিদের প্রতি তাঁর অন্যরকম এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
১৮৭৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আর এ সময়েই তাঁর ভবিষ্যত জীবনের ভিত গড়ে ওঠে। রেভারেন্ড ফাদার লাফোন্ট-এর উৎসাহে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে উঠেন। লাফোন্টের উদ্যোগে তাকে পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়, পরের বছরগুলোতে তিনি পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা করেন। তবে প্রথম বছরে তিনি পড়েছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে। পরে ১৮৮৪ সালে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে ট্রাইপজ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সাফল্যের সাথে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে একই সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি ডিগ্রি লাভ করেন।
আলো কেমন করে পথ চলে? আলোর ধর্মই বা কেমন? এমনই সব বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। আকাশ-তরঙ্গ ও বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গের (ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ওয়েভ) ওপর গবেষণা করতে গিয়েই জগদীশচন্দ্র বেতার বা রেডিওর মূলনীতি আবিষ্কার করেন। বিনাতারে শব্দ প্রেরণের ‘ক্রিস্টাল রিসিভার’ নামের যে বেতার যন্ত্রটি তিনি আবিষ্কার করেন, তার সাহায্যে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে অবস্থিত তাঁর বাসভবনে সাংকেতিক শব্দ প্রেরণ করা যেতো।
আলো কেমন করে পথ চলে? আলোর ধর্মই বা কেমন? এমনই সব বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। আকাশ-তরঙ্গ ও বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গের (ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ওয়েভ) ওপর গবেষণা করতে গিয়েই জগদীশচন্দ্র বেতার বা রেডিওর মূলনীতি আবিষ্কার করেন। বিনাতারে শব্দ প্রেরণের ‘ক্রিস্টাল রিসিভার’ নামের যে বেতার যন্ত্রটি তিনি আবিষ্কার করেন, তার সাহায্যে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে অবস্থিত তাঁর বাসভবনে সাংকেতিক শব্দ প্রেরণ করা যেতো।
![]() |
ছবি দুইটি যন্ত্র জগদীশচন্দ্র বসুর রেডিওর দুইটি অংশ, প্রথম যন্ত্রটি প্রেরক যন্ত্র, আর পরেরটি গ্রাহক যন্ত্র |
এছাড়া তিনি নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে অদৃশ্য-আলোতেও দৃশ্যমান আলোর সকল ধর্মই বর্তমান। আর তাঁর এসব গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল বিশ্বের প্রধান প্রধান বিজ্ঞান সাময়িকীগুলোতে প্রকাশিত হয়। তার গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করেই ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.এস.সি ডিগ্রি দেয়। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৭- এই সময়ে জগদীশচন্দ্র বসু জীব ও জড়ের উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে গভীর পড়াশোনা ও গবেষণা করেন। তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান যে, জীব ও জড় বস্তুর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ তাদের আণবিক গঠনে একই রকম উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এ ধরনের কিছু ধারাবাহিক গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে প্রাণীদেহে এবং শাকসবজির কোষসমূহ বৈদ্যুতিক ক্রিয়া দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়, সাড়া দেয়। এছাড়া তাপ, ঔষধ, রাসায়নিক দ্রব্য এবং যান্ত্রিক চাপেও একইভাবে এরা উদ্দীপ্ত হয়। তিনি আরও দেখিয়েছেন, একইভাবে নির্দিষ্ট কিছু অজৈব পদার্থেও সমরূপ উদ্দীপনা ঘটানো যেতে পারে।
জগদীশ বসু উদ্ভাবিত বিভিন্ন যন্ত্রের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যন্ত্রটির নাম ক্রেসকোগ্রাফ। এটি সামান্য নড়াচড়াকে এক কোটি গুণ বিবর্ধিত করে মানুষের দৃষ্টিগোচর করে তুলতে পারে। এছাড়াও পরিবাহিতা পরিমাপক, ট্রান্সপিরোগ্রাফ, ফটোসিনথেটিক গ্রাহক এবং চৌম্বক রেডিওমিটার তাঁর উদ্ভাবিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র।
জগদীশ বসু উদ্ভাবিত বিভিন্ন যন্ত্রের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যন্ত্রটির নাম ক্রেসকোগ্রাফ। এটি সামান্য নড়াচড়াকে এক কোটি গুণ বিবর্ধিত করে মানুষের দৃষ্টিগোচর করে তুলতে পারে। এছাড়াও পরিবাহিতা পরিমাপক, ট্রান্সপিরোগ্রাফ, ফটোসিনথেটিক গ্রাহক এবং চৌম্বক রেডিওমিটার তাঁর উদ্ভাবিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র।
জগদীশচন্দ্র বসু কিন্তু বেশ লেখালেখিও করেছেন। আপনারা তো এখন কতো সায়েন্স ফিকশন পড়েন, তাই না? বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাই ফাই গল্পটি কিন্তু তিনিই লিখেছিলেন। এছাড়াও বিজ্ঞানের নানা বিষয় খুব সহজ করে বাংলায় অনেকগুলো বিজ্ঞানভিত্তিক লেখাও লিখেছিলেন। আর সেসব লেখাগুলো একত্র করে পড়ে একটা বইয়ে সংকলনও করা হয়েছে, নাম ‘অব্যক্ত’; আকারে খুব একটা বড়ো নয়, পারলে ওটা জোগাড় করে পড়ে নিয়েন।
আমাদের বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কী বলেছেন জানেন? ‘জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন, তার যে কোনটির জন্যই বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।’ একরম এক বিজ্ঞানীর দেশে জন্মেছি বলে আমরা গর্ব করতেই পারি, তাই না?
জগদীশচন্দ্র বসু চেয়েছিলেন, তাঁর নিজ গ্রাম রাঢ়িখালে নির্মাণ করেছিলেন ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’, যেখানে বাংলায় বিজ্ঞানের চর্চা হবে, বাঙালি ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানের চর্চা করবে। অবহেলায় সেই বিজ্ঞান মন্দির এখন জীর্ণ, তাই বলে কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর কীর্তি মলিন হয়নি।
লেখকঃ মোঃ মিন্টু হোসেন।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজার পথিক।
আমাদের বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কী বলেছেন জানেন? ‘জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন, তার যে কোনটির জন্যই বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।’ একরম এক বিজ্ঞানীর দেশে জন্মেছি বলে আমরা গর্ব করতেই পারি, তাই না?
জগদীশচন্দ্র বসু চেয়েছিলেন, তাঁর নিজ গ্রাম রাঢ়িখালে নির্মাণ করেছিলেন ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’, যেখানে বাংলায় বিজ্ঞানের চর্চা হবে, বাঙালি ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানের চর্চা করবে। অবহেলায় সেই বিজ্ঞান মন্দির এখন জীর্ণ, তাই বলে কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর কীর্তি মলিন হয়নি।
লেখকঃ মোঃ মিন্টু হোসেন।
সম্পাদনায়ঃ জানা অজার পথিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন