বাদুড় এবং রাডার

বাদুড়কে যদিও আমরা পাখি বলে জেনে থাকি, আসলে তা ঠিক নয়। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, বাদুড় পাখি নয়। একটি বিশেষ ধরণের প্রাণী। এর পেছনে অবশ্য জোরাল যুক্তিও তারা দাঁড় করিয়েছেন। সম্ভবত বাদুড়ই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী,যার পাখা আছে। বাদুড় পাখির মতো ডিম পাড়ে না। বাচ্চা প্রসব করে। এসব কিছু মিলিয়ে তারা বাদুড়কে ফ্লাইং ম্যামালিয়ান বা উড়ন্ত স্তন্যপায়ীদের বিভাগে ফেলেছেন।


এবার আসল কথায় আসা যাক। কেউ যদি কোন জিনিস সহজে না দেখে, তখন আমরা তাকে বাদুড় চোখ বলে গাল দেই। বিদেশিরা বলে "ব্লাইণ্ড এজ এ বেট" বা বাদুড়ের মত অন্ধ। কিন্তু কথাটা আদৌ কি ঠিক? এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামিয়েছেন বহু বছর ধরে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর কথা। একজন ইটালিয়ান বিজ্ঞানী 'স্পালাঞ্জানি' (Spallanzani)। তিনি কতকগুলো বাদুড় ধরে ওদেরকে দুটি গ্রুপে ভাগ করেন। প্রথম গ্রুপের সবকটি বাদুড়ের চোখ বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু অন্য গ্রুপের বাদুড়দের চোখ খোলা রাখলেন। পরে দু'টি গ্রুপকে তিনি খোলা মাঠে ছেড়ে দিলেন; তখন দেখতে পেলেন দুই গ্রুপের বাদুড় সমান উড়ছে। কেউ কারো চেয়ে কম যায় না।এ থকে তিনি ধারণা করলেন, তাহলে চোখ বন্ধ করে দিলেও বাদুড় দেখতে পায়। তিনি বাদুড়ের এই বোধশক্তিকে বলেছেন, 'অলটারনেটিভ পাওয়ার অব সাইট" বা বিকল্প দৃষ্টিশক্তি। তাহলে প্রশ্ন এই বিকল্প শক্তিটা কি?

এবার স্পালানজানি আরেকটি মজার কাণ্ড ঘটালেন। তিনি একটি প্রকাণ্ড হলঘরের চার দেয়ালে অসংখ্য ইলেকট্রিক তার ফিট করলেন। ঘরের সবকটি লাইট অফ করে এটাকে অন্ধকার কুণ্ডের মতো বানালেন। এবার সেখানে ছেড়ে দিলেন একদল বাদুড়। তার ধারণা ছিলো বাদুড়রা নিশ্চয়ই অন্ধকারে বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে আসামাত্রই তড়িতাহত হয়ে মারা পড়বে। কিন্তু আশ্চর্য! এমন গাঢ় অন্ধকারে একটি বাদুড়ও মারা পড়েনি। স্পালানজানি এতক্ষণে দারুণ চিন্তায় পড়লেন।

এবার উপায়? তিনি এবার বাদুড়গুলোর চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দেন। ফলাফল আরো ওয়ান্ডারফুল! এ পরীক্ষায়ও কোন বাদুড় মারা পড়েনি। অন্ধকার ঘরে ওরা আনন্দে ঘুরাফেরা করছে। পরে ওদের কান বন্ধ করে দিয়ে দেখলেন, কতক্ষণের মধ্যে মারা পড়ল কয়েকটি বাদুড়। বিজ্ঞানী সাহেব ভাবলেন তাহলে ওরা কান দিয়ে দেখে। এবার চোখ আর কান খোলা রেখে মুখ দিলেন বন্ধ করে। এবারও সে রকম পরিস্থিতি বাদুড়রা যেন অসহায়ভাবে হাঁটাহাঁটি করছে। কেউ কেউ দিশেহারা হয়ে আটকে মারাও পড়ছে।

চিন্তামগ্ন বিজ্ঞানীর এবার সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, নিশ্চয়ই বাদুড়ের মুখ আর কান তাকে অন্ধকারে চলতে সাহায্য করে। এখানে তার চোখের কোন ভূমিকা নেই।

A depiction of the ultrasound signals emitted by a bat and the echo from a nearby object
দীর্ঘদিনের গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, বাদুড়ের সিক্সথ সেন্স বা ষষ্ঠ অনুভূতি, যার নাম 'ইয়ার মাউথ রিলেশনশিপ'। বাদুড়ের মুখে ও কানের সাথে যে নিবিড় সম্পর্ক আছে, তা দিয়েই বাদুড় অন্ধকারে দিব্যি ছুটাছুটি করে। তারা এক ধরণের বিচিত্রময় শব্দ করে, তা বাতাসে ভেসে ভেসে সামনে এগিয়ে যায়। ওদের চলার পথে যে জিনিস পড়ে, তার মধ্যে ধাক্কা লাগে। প্রতিফলিত শব্দ শুনেই বাদুড় বুঝতে পারে সামনে এখন কি পড়বে? এ শব্দ ঠিক সে শব্দ নয় যা বাদুড় মুখে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে উচ্চারণ করে। বাদুড়ের সে অদ্ভুত শব্দ আমরা শুনতে পাই না। শব্দ বিজ্ঞানীরা বের করেছেন, তাতে রয়েছে তরঙ্গ ও কম্পাংকের এক নিগুঢ় সম্পর্ক।


শব্দ সামনের দিকে চলে তরঙ্গ বা ঢেউয়ের আকারে। শব্দের তরঙ্গ আড়াআড়ি ভাবে চলে বলে এর নাম তরঙ্গ। একটি সহজ উদাহরণঃ কোন একখানি তারের এক প্রান্ত বেঁধে অন্য প্রান্ত ধরে তারের লম্বা দিকের সমকোণে ঝাঁকুনি দিলে তারে যে ধরণের তরঙ্গ জাগে, সেটাই শব্দতরঙ্গ। আর কম্পাংক (Frequency) হচ্ছে কোন কম্পমান বস্তু প্রতি সেকেন্ডে যতগুলো পূর্ণ স্পন্দন সম্পন্ন করে সেটাই।

Waves of different frequencies
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বাদুড়ের এ ধরণের শব্দ তরঙ্গের কম্পাংক প্রায় ২০-২০০kHz কাছাকাছি। কিন্তু আমরা মাত্র সেসব শব্দ শুনতে পাই যাদের কম্পাংক আনুমানিক ২০Hz থেকে ২০kHz এর ভিতর। এর বেশি বা কম হলে সে সব শব্দ আমাদের কানে পোঁছে না। অতএব, বাদুড়ের সে উচ্চ কম্পাংকের শব্দ আমরা শুনতে পাই না।


বিজ্ঞানীদের ভাষায়, বাদুড়ের এই অনুভূতি হচ্ছে ন্যাচারাল রাডার। রাডার এমন এক ধরনের প্রণালী, যা তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের দ্বারা বিমান, জাহাজ প্রভৃতির দিক ও দূরপাল্লা নির্ণয় করে। বাদুড় যেখানে শব্দতরঙ্গের (সাউন্ড ওয়েভ) সাহায্যে গতিপথ নির্ণয় করে। সেখানে আধুনিক রাডার কাজ করে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে (ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভ)।

Sonar Principle

বাদুড়ের এই রাডার সিস্টেম যেমন মুখ ও কান দুটি অংশ আছে; তেমনি রাডারের মধ্যেও রয়েছে দুটি প্রধান অংশ প্রেরক যন্ত্র ও গ্রাহক যন্ত্র। একটি ট্রান্সমিটার, অন্যটি রিসিভার। মুখ দিয়ে তৈরি শব্দের প্রতিফলিত রূপ কান দিয়ে শুনা যায় বলে, মুখ হচ্ছে ট্রান্সমিটার আর কান রিসিভার। সুতরাং দেখা গেল রাডার আর কিছুই নয়, বাদুড়ের একটি বিশেষ অনুভূতির ব্যাবহারিক রূপ মাত্র। রেডিও ডিটেকশন এন্ড রেঞ্জিং (Radio Detection And Ranging) শব্দটির সংক্ষিপ্ত রূপই রাডার (RADAR)।


আকাশে উড়োজাহাজ উড়ার জন্য,সাগরে জাহাজ চলার জন্য, নিজস্ব সীমানার ভেতর শত্রুপক্ষের বিমান ধরার জন্য আজ ব্যবহৃত হচ্ছে রাডার। তাই মানুষ এই রাডার পদ্ধতি শিক্ষালাভ করেছে সরাসরি বাদুড় থেকে, এ সত্যটি অস্বীকার করার কি কোন জো আছে?

শব্দের গতি প্রতি সেকেন্ডে এগারোশত বিশ ফুট। বাদুড় এইন শব্দ গতিকে কাজে লাগিয়ে চলাফেরা করে। কিন্তু উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে তা আর এই গতিকে কাজে লাগালে চলে না। কেননা শব্দের গতির চেয়ে উড়োজাহাজের গতি অনেক বেশি বলে পাঠানো শব্দ ফিরে আসার আগেই উড়োজাহাজ সে দূরত্ব পেরিয়ে যাবে। সে জন্যই উড়োজাহাজ বা আধুনিক যন্ত্রগুলোতে ব্যবহার করা হয় তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ,যার গতি শব্দের গতির চেয়ে হাজার হাজার গুন বেশি। আলোর গতি যেখানে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল, সেখানে শব্দের গতি ব্যবহার করার তো প্রশ্নই আসে না।

A vampire bat
এই রাডার নীতিকে কাজে লাগিয়ে এক জাতের হিংস্র বাদুড় মানুষের ক্ষতি করে থাকে। এদের নাম 'ভ্যাম্পায়ার'। পাওয়া যায় লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ব্রাজিল, মেক্সিকো, ত্রিনিদাদ প্রভৃতিতে। গহীন বনে নাস করে এরা। বাদুড় যেখানে ফল আর পোকা মাকড় খেয়ে জীবন কাটায়; সেখানে এরা খায় তাজা রক্ত। ওরা ভয়ানক রক্তচোষা। কোন স্থানে মানুষের আনাগোনা অনুভব করলেই তারা সেখানে রাতের আঁধারে চোরের মত হানা দেয়। আর চুপিসারে খেয়ে যায় ঘুমন্ত মানুষের রক্ত।

A vampire bat feeding on a pig
এদের বোধশক্তি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মরা বাঁচা বুঝবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা এদের রয়েছে। দু'খানা ঘরে একটিতে রাখা হল একজন জীবন্ত মানুষ, আর অন্যটিতে রাখা হল একজন জীবন্ত মানুষ। আশ্চর্যের বিষয়, কোনরূপ ভাবনা চিন্তা ছাড়াই এরা হামলা চালালো জীবন্ত মানুষটির ওপর। এবার একই ঘরে একই খাটে ওপর শুইয়ে রাখা হলো দুটি দেহ, একটি জীবন্ত আর অপরটি মৃত। এবারও ভ্যাম্পায়ারের প্রথম ঠোকর গিয়ে পড়ল জীবন্ত মানুষটির ঘাড়ে। বিজ্ঞানীরা বারবারই বিস্মিত হয়েছেন এদের আশ্চর্য রকমের বুদ্ধিজ্ঞানে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এরা মানুষের যমদূত। কেননা এরা নিজেদের শরীরে করে বয়ে আনে 'রেবিস' নামের এক জাতের ভাইরাস। আর কোন সুস্থ লোককে কামড়ানোর সময় তার দেহে ছেড়ে দেয় এই জীবাণুগুলো। পরিণামে লোকটি শিকার হয় জলাতঙ্কে (Hydrofobia) রোগের। ভাইরাসবাহী কুকুর, শিয়াল, বনবিড়াল, নেড়ি ইঁদুর ইত্যাদির কামড়েও এই রোগ হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাহক প্রাণীটিও মারা পড়ে একই রোগের শিকার হয়ে। আর ভ্যাম্পায়ার? তারা হলো শুধুমাত্র বাহক। রেবিস ওদের কোন ক্ষতিই করতে পারে না।


ভ্যাম্পায়াররা যাই হোক না কেন, বাদুড় হতে রাডার এটি একটি চিরন্তন সত্য কথা। এই রাডার নীতিকে ব্যবহার করে আজকের বিজ্ঞান সাধন করেছে সভ্যতার এক বিপুল কল্যাণ। ঝড়ো বাতাস কিংবা দুর্যোগপূর্ণ রাতের বেলায়ও বিমানচালক ও জাহাজের কাপ্তানরা অতি সহজেই নিজেদের অবস্থান ও দিক নির্ণয় করতে পারেন। একখানা উড়ন্ত বিমান যখন বন্দরে অবতরণ করে, সেখানে পাইলট বিমানের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখেন রাডারের সাহায্যে। বন্দর হতে পাঠানো রাডার সিগন্যাল পেয়েও তিনি বুঝতে পারেন, তাকে এখন কি করতে হবে।

বাতাসে অধিক জলীয় বাষ্প আছে। বাষ্প ধূলিকণার উপর ভর করে জলকণায় পরিণত হচ্ছে। সে সংবাদটিও পাচ্ছেন আবহাওয়ার গবেষকেরা রাডারের সাহায্যে।

সাধারণ রাডার হতে আরো অনেকগুণ বেশি শক্তিশালী লেসার রাডার (Laser Radar)। কোন মেঘাচ্ছন্ন বাদলা দিনে অথবা ঘন কুয়াশায় ঘেরা শীতের আকাশে মেঘের গঠন ও ঘনত্ব, বায়ু দূষণ সম্পর্কে সাধারণ রাডার যেখানে সঠিক ফল দেয় না, ঠিক সেখানেই লেসার রাডার তার যাদুকরী ক্ষমতা দেখায়।


পাহাড়ের মত উঠানো কয়েক তলা মেঘও লেসার রশ্মির বেপরোয়া গতিকে রুখতে পারে না। এ ভয়ংকর আলো অনায়াসেই ছুটে চলে ধোয়া কৃত বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে। তাই অতীতে যেমন আকাশের বিষাক্ত বাতাস অনেক পাইলটের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো কিংবা মেঘের অধিক ঘনত্বের দরুন অনেক বিমানের মারা পড়ারও উপক্রম হয়েছিল, বর্তমানে আর সে অসুবিধা একদম নেই।

বর্তমানে সময়ে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগে সন্ধানী মানুষ নবতর আবিষ্কারের স্বপ্নে বিভোর। সভ্যতার কল্যাণে নিজের অবদানের কথা মনে করে সে হয়তো গর্ব বোধ করে। কিন্তু তাকে ভুলে গেলে চলবে না, 'বাদুড়' নামের একটি নগণ্য প্রাণীও যে তার শিক্ষক।

লেখকঃ জানা অজানার পথিক।
hybridknowledge.info

৪টি মন্তব্য:

  1. বাদুর কি তাহলে দেখতে পায় না ?

    উত্তরমুছুন
  2. যে সব প্রানির কান দেখা জায় তারা বাচ্চা প্রসব করে আর - জাদের কান দেখা জায় না তারা ডিম পারে - বেতিক্রম ও আছে - আমি এক ওয়াজ মাহফিলে সুনে ছিলাম

    উত্তরমুছুন

জানার কোন অন্ত নাই, জানার ইচ্ছা বৃথা তাই, ভেবে যদি জানার ইচ্ছাকে দমন করে রাখা হয় তবে সে জীবনের কোন অর্থ নাই। কিন্তু সব জানতে হবে এমন কোন কথা নাই, তবে জানার ইচ্ছা থাকা চাই। আমাদের এই জানা জানির ইচ্ছকে সূত্র করে, আমাদের ছোট্ট একটি প্রয়াস ❝আমি জানতে চাই❞। আমাদের জানতে চাওয়ার ইচ্ছা পুরনের লক্ষে কখনো জেনেছি মহাকাশ নিয়ে, কখনো জেনেছি সমুদ্র নিয়ে, কখনো ডুব দিয়েছি কৌতুক এর মাঝে, আবার ভয়ে কেঁপেছি ভুতের গল্প পড়ে, কখনোবা শিউরে উঠেছি কিছু মানুষের কার্যকলাপ জেনে। কখনো জেনেছি নতুন আবিষ্কারের কথা, আবার জেনেছি আদি ঐতিহ্যের কথা, এত সব কিছু করেছি শুধু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা থেকে।

hybridknowledge.info hybridknowledge.info